বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
সাম্রাজ্যবাদীরা কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। অতীতের দিকে তাকালে এমনটাই দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক, রোমান থেকে শুরু করে হাল আমলের ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভূরাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ মারাত্মকভাবে রাজনৈতিক অজ্ঞতাকে ত্বরান্বিত করেছে। যেমনভাবে দুই দশক আগে ইরাকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এমন বাস্তবতায় ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে রাশিয়া বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে, চলেছে ভুল করে।
ইউক্রেনে হামলার সাত মাস চলছে। এরই মধ্যে মস্কোর জন্য হিতে বিপরীত ফল হতে শুরু করেছে। মুহূর্তের মধ্যে ইউক্রেন দখল করার ক্রেমলিনের যে পূর্বানুমান ছিল, তা ভেস্তে গেছে। এ যুদ্ধে রাশিয়ার পশ্চাৎপদতার বিষয় নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছেন আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা। যেখানে পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাঁচটি একরোখা মারাত্মক ভুলকে দায়ী করছেন।
পুতিন দীর্ঘায়িত যুদ্ধের জন্য রুশ বাহিনীর প্রস্তুতিকে অতি মূল্যায়ন করেছেন। এটি তার প্রথম ভুল হিসেবে ধরা দিয়েছে। এ ছাড়া বলপ্রয়োগ করে সাম্রাজ্য বিস্তারে রুশদের ইচ্ছাকেও ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যে কারণে সামরিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও দৃঢ়চেতা শত্রুর সঙ্গে বেশ ব্যয়বহুল ও অপমানজনক এক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে মস্কো। যেখানে ইউক্রেনীয় জনগণ স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দিয়ে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করছেন। অন্যদিকে রুশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে।
দ্বিতীয়ত, পুতিন ভেবেছিলেন আক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করবে কিয়েভ। অন্যান্য দখলদারীর মতো পুতিনও একই ভুল করেছেন। এমন আক্রমণের বিপরীতে ইউক্রেনীয়রা যে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারেন, তা কল্পনা করতে পারেননি তিনি। পাশাপাশি তাদের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতি যে প্রতিশ্রুতি, তারও অবমূল্যায়ন করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের অংশীদারত্বমূলক ইতিহাসের কারণে আবারও একটি অংশীদারত্বমূলক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছিলেন পুতিন। যেখানে অধিকাংশ ইউক্রেনীয়ই এ সাম্রাজ্যবাদী অতীত ভেঙে ফেলতেই আগ্রহী। পুতিনের শুরু করা এ যুদ্ধ তাদের দেশপ্রেমকে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, যা বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি। আর এতে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো।
পুতিনের তৃতীয় ভুল ন্যাটোকে দুর্বল ভাবা। তার হিসাবমতে, নিরাপত্তার বিষয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির পর দুর্বল হয়ে পড়েছে এ পশ্চিমা সামরিক জোট। তাই প্রাচ্যের ঘটনাতে এ জোট ধীর প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে ধারণা করছিলেন তিনি।
চতুর্থত, পুতিন ভেবেছিলেন তেল ও গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ইউক্রেনের জন্য তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না ইউরোপ। এখানেই ছিল তার বড় গলদ। যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী পদক্ষেপ, ইউরোপের উদ্বেগ ও আগ্রাসী রাশিয়ার কর্মকাণ্ড আটলান্টিকের এ দুই প্রান্তকে বরং আরও ঘনিষ্ঠ করেছে।
পুতিনের পঞ্চম ভুল ধারণা ছিল আফগান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল পদক্ষেপ, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যা এবং চীনের উত্থান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশটি ইউক্রেন বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। তিনি ভেবেছিলেন, ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় অনুপ্রবেশ, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংযুক্তি এবং পশ্চিমা নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের মতো ইউক্রেন ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্র ভীত প্রতিক্রিয়া জানাবে। কিন্তু দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধকে পশ্চিমা দেশগুলোকে একজোট করার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। একই সঙ্গে মস্কোর অর্থনীতিকে ভাঙার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, তিনি এসব বিষয়কে পুতিনের অহঙ্কার এবং নিজের মতবাদকে অন্যের তুলনায় বেশি প্রাধান্য দেওয়ার ফল বলে বিবেচনা করছেন। শুধু ব্যক্তি ও জাতিগত মহত্ত্ব দ্বারা চালিত হয়েই তিনি উদারপন্থি ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে গেছেন।
এ বিশ্লেষকের মতে, একজন কঠোর স্বৈরশাসক হিসেবে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি (পুতিন) নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি ও ব্যক্তিগত মতবাদের বাইরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা আন্তর্জাতিক কোনো নিয়মনীতিরই তোয়াক্কা করেননি।
তবে পশ্চিমারা যুদ্ধ ছাড়া পুতিনের সামনে আর কোনো বিকল্প রাখেনি এমনটি নয়। বরং রাশিয়ার কাছে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবেই তারা যুদ্ধকে বেছে নিয়েছে। পুতিনের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ইউক্রেন নেতার সঙ্গে ফলপ্রসূ কোনো কূটনৈতিক আলোচনা হতে পারে না। তাই ইউক্রেনকে তোয়াজ না করে একে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, এমনকি একসময় পুতিন যে কাজগুলোর জন্য পশ্চিমাদের সমালোচনা করে এসেছেন, এখন তিনি নিজেই সেসব করছেন; যা পুরো বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের মনোভাবকে ক্ষুণ্ন করেছে।
তবে পুতিনকে উন্মাদ বলা হলে যুক্তরাষ্ট্রকেও ধোয়া তুলসী পাতা বলা যায় না। বাইডেন প্রশাসন বরাবরই ইউক্রেনে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য রাশিয়ার নিন্দা করে গেছে। কিন্তু তারাই আবার ইরাকে একই সহিংসতা চালিয়েছে, যার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে দেশটির নাগরিকদের। একজন মার্কিন সিনেটর হিসেবে এমন মারাত্মক যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য বাইডেন কখনও ক্ষমা চাননি।
একদিকে ওয়াশিংটন ইউক্রেন যুদ্ধকে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে লড়াই হিসেবে আখ্যা দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং অন্যান্য অগণিত যুদ্ধ ও দখলদারিত্বের বিপরীতে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল যখন সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের ভূমি অধিগ্রহণ করে, তখন তারা নীরব ভূমিকা পালন করে। কখনওবা প্রচ্ছন্ন সহায়তাও দেয়।
যে কারণে স্বঘোষিত ইহুদিবাদী নেতা জো বাইডেন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্তেও নীরব থাকেন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকেও বাইডেনের পথে হাঁটতে দেখা যায়।
মূলত অহঙ্কার ও কপটতা পতন ঘটাতে পারে বড় কোনো সাম্রাজ্যেরও। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নিজ নিজ জায়গা থেকে যুদ্ধকে বৈধতা দিতে যেসব ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে, তা মানুষের মনে বিরক্তিই তৈরি করছে। আমরা প্রাচীন গ্রিকদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ট্র্যাজেডি সম্পর্কে জানি। কারণ থুসিডাইডিস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে তার অনবদ্য ইতিহাসের বর্ণনা করে গেছেন।
এসব ইতিহাস জেনেও বিশ্বশক্তিগুলো কেন একই ভুল করছে? অহঙ্কার কি তবে পাগলামিও ডেকে আনে?
আমাদের মনে রাখতে হবে, বুদ্ধিমানরা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। বিজ্ঞরা অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। কেবল বোকারা কারও কাছ থেকে কোনো শিক্ষা নেন না, যা আমরা আজ ইউক্রেনে দেখতে পাচ্ছি।
ভয়েস/আআ